২৮ বছর একা জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিলেন জাপানি সৈনিক, জানতেন না যে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন জাপানি সৈনিক শোইচি ইয়োকোই। তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ২৮ বছর পর তাঁকে গুয়ামের গভীর জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় । ছবি: এপি
মার্কিন সেনাদের হাতে ধরা পড়ার আতঙ্কে গুয়ামের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন জাপানের সৈনিক শোইচি ইয়োকোই। বিশ্বে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সাগরের মাছ, ব্যাঙ ও ইঁদুর খেয়ে তিনি জঙ্গলে টিকে ছিলেন ২৮ বছর। আজ তাঁকে ঘিরে স্মৃতিচারণার আয়োজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন অঞ্চলের গুয়াম দ্বীপপুঞ্জে মুখোমুখি জাপানি ও মার্কিন সেনারা। মার্কিন বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে জাপানিরা প্রায় পরাভূত। গুয়ামের গভীর জঙ্গলে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে আত্মগোপন করলেন জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল শোইচি ইয়োকোই।
তারপর ঘটে এক চমকপ্রদ ঘটনা। ১৯৭২ সালের আজকের দিনে (২৪ জানুয়ারি) গুয়ামের গভীর জঙ্গল থেকে শোইচি ইয়োকোইকে উদ্ধার করা হয়। তত দিনে প্রায় ২৮ বছর কেটে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর জাপান আত্মসমর্পণ করেছে। এমনকি যুদ্ধের ক্ষত সেরে উঠে জাপান বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর একটি হয়ে উঠেছে।
কিন্তু শোইচি এসবের কিছুই জানতেন না। যুদ্ধ থেকে বাঁচতে গভীর জঙ্গলে একাকী আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, ধরা পড়লে মার্কিনিদের হাতে যুদ্ধবন্দী হতে হবে, যা তাঁর নিজের, তাঁর পরিবারের এবং তাঁর দেশের জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক হবে। তাই বনবাসকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
যদিও শোইচি আশা করেছিলেন, একদিন নিশ্চয়ই তাঁর সাবেক সঙ্গীরা এসে তাঁকে খুঁজে বের করবেন। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
ঠিক আজ থেকে ৫৩ বছর আগে, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি, গুয়ামের গভীর জঙ্গলে স্থানীয় শিকারিরা শোইচিকে খুঁজে পান। তখন তাঁর বয়স হয়ে গিয়েছিল ৫৭ বছর। পরবর্তীতে তাঁকে ‘যুদ্ধের নায়ক’ হিসেবে সংবর্ধনা জানিয়ে জাপানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তবে তিনি জাপানের আধুনিক জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। সেই জীবনে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি।
শোইচি ইয়োকোইয়ের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়। ১৯১৫ সালের ৩১ মার্চ জাপানের আইচি প্রদেশের শাওরিতে। তিনি গত শতাব্দীর দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি জাপানের রাজকীয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।
ভীত ও দুর্বল ছিলেন
গভীর জঙ্গল থেকে শোইচি ইয়োকোইকে উদ্ধারের ঘটনায় তাঁর ভাইপো, অমি হাতাশিন বলেন, সেই সময় শোইচি খুব ভীত ছিলেন।
জঙ্গলের এত বছর একাকী থাকার পর হঠাৎ এত মানুষ দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি সঙ্গে থাকা একটি শিকারের রাইফেল তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে দীর্ঘ সময় অপুষ্টি ও অনাহারে থাকার ফলে তিনি শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, সেটি সম্ভব হয়নি।
হাতাশিন আরও বলেন, ‘তিনি (শোইচি) ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, লোকেরা তাঁকে যুদ্ধবন্দি করে নিয়ে যেতে এসেছে। এটি একজন জাপানি সেনা ও তাঁর পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয় হতো।’
অর্থাৎ উদ্ধারের সময় শোইচি জানতেন না যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ২৮ বছর আগে। তিনি তাঁর জঙ্গলবাসের সময়ে বাইরের পৃথিবীর খবর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলেন।
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বই
উদ্ধারের দুই বছর পর শোইচির অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়। জাপানি ভাষায় প্রকাশিত এই বইটিতে উদ্ধারকারীদের অভিজ্ঞতার কথাও স্থান পেয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে গল্পগুলো শুনে বইটি লিখেছেন হাতাশিন।
২০০৯ সালে শোইচির সেই বইটি ইংরেজি ভাষায়ও প্রকাশিত হয়। বইটির নাম দেওয়া হয় ‘প্রাইভেট ইয়োকোই’স ওয়ার অ্যান্ড লাইফ অন গুয়াম, ১৯৪৪–১৯৭২’।
হাতাশিন বলেন, ‘আমি তাঁকে (শোইচি) নিয়ে গর্বিত। তিনি ছিলেন লাজুক ও শান্ত স্বভাবের একজন মানুষ। তবে তাঁর উপস্থিতি ছিল অসাধারণ।’
ব্যাঙ ও ইঁদুর খেয়ে বেঁচে ছিলেন
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে গুয়ামে মার্কিন বাহিনী জাপানি সেনাদের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এর ফলে জাপানিদের প্রতিরোধ ভেঙে যায়। এই পরিস্থিতিতে শোইচির দীর্ঘ অগ্নিপরীক্ষার শুরু হয়।
লড়াই এতটাই ভয়াবহ ছিল এবং হতাহতের সংখ্যা এত বেশি হয়েছিল যে শোইচির ওপর তাঁর প্লাটুন রক্ষার দায়িত্ব পড়ে। তখন জাপানিদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। শোইচি ও তাঁর সঙ্গীরা জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যান।
হাতাশিন লিখেছেন, ‘জাপানি সেনারা পালিয়ে থাকার সময় ধরা না পড়ার জন্য খুবই সতর্ক ছিলেন। তাঁরা চলার পথে নিজেদের পায়ের ছাপ মুছে ফেলতেন।’
প্রথম দিকে তাঁরা স্থানীয় জনগণের পশু ধরে খেতেন। পরে সেনাদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। একপর্যায়ে তা মাত্র কয়েক ডজনে নেমে আসে।
মার্কিন বাহিনীর টহল ও স্থানীয় শিকারিদের কারণে জাপানি সেনারা গুয়ামের ঘন জঙ্গলের আরও গভীরে চলে যান। তখন তাঁদের খাদ্য ছিল ব্যাঙ, নদীর ইল এবং ইঁদুর। এদের মধ্যে কিছু ব্যাঙ বিষাক্ত ছিল।
নদী থেকে ইল ধরার জন্য শোইচি ফাঁদ তৈরি করেছিলেন। নিজের জন্য তিনি একটি নিরাপদ ভূগর্ভস্থ আশ্রয় তৈরি করেছিলেন, যা মজবুত বাঁশ দিয়ে তৈরি ছিল। হাতাশিন বলেছেন, ‘তিনি (শোইচি) অত্যন্ত দক্ষ একজন ব্যক্তি ছিলেন।’
হাতাশিন আরও বলেন, ‘গভীর জঙ্গলে টিকে থাকার জন্য শোইচিকে অনেক চিন্তা করতে হতো। ফলে পরিবার বা নিজের দুর্দশা নিয়ে ভাবার সময় খুব কম পেতেন।’
আট বছর একাকী জীবন
ধীরে ধীরে রোগ, ক্ষুধা ও শোকে শোইচি তাঁর সঙ্গীদের হারাতে শুরু করেন। সর্বশেষ দুজন সঙ্গীও ১৯৬৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় মারা যান। এরপর শোইচি পুরোপুরি একা হয়ে পড়েন। উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে প্রায় আট বছর গভীর জঙ্গলে একাকী কাটাতে হয়েছিল।
জঙ্গলে একবার ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শোইচি। তিনি ভেবেছিলেন, এবার হয়তো মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু তাও তিনি নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। শোইচির ভাষায়, “না, এখানে আমি মরতে পারি না। আমি আমার মরদেহ শত্রুর সামনে রাখতে পারব না। মৃত্যুর আগে আমাকে অবশ্যই গর্তে ফিরতে হবে। এতদিন বেঁচে ছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব কিছুই ব্যর্থ হতে চলেছে।”
দ্বিতীয়বার উদ্ধার হওয়ার দুই সপ্তাহ পর শোইচিকে জাপানে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে এক বীর হিসেবে বরণ করা হয়।
দেশে ফিরে আসার পর শোইচির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। টিভি এবং রেডিও চ্যানেলগুলোতে একের পর এক সাক্ষাৎকার দেন তিনি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে ডাকতে থাকে।
তবে আধুনিক জাপানের ব্যস্ত জীবনধারা কখনও শোইচিকে স্বস্তি দিতে পারেনি। হাতাশিন বলেন, “বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি। একদিন তিনি ১০ হাজার ইয়েনের একটি নতুন ব্যাংকনোট দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা এখন মূল্যহীন।’”
শোইচি তার পুরানো জীবন নিয়ে গভীর নস্টালজিয়ায় ভুগতেন, হাতাশিনের মতে। তিনি কয়েকবার নিজের স্ত্রীকে নিয়ে গুয়াম দ্বীপে গিয়েছিলেন। এখনো সেখানে তাঁর বানানো মাছ ধরার ফাঁদ, ছবিসহ কিছু নিদর্শন জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নাগোয়া, জাপানে ৮২ বছর বয়সে শোইচির মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
Comments
Post a Comment