নীলাভ সকাল। স্নিগ্ধ হাওয়া গায়ে এসে লাগে। রীনার মনটা অনেক দিন ধরেই ভারাক্রান্ত। ব্যস্ত শহুরে জীবনে যেন কোনো শান্তি নেই। তাই আজ সে সিদ্ধান্ত নেয় শহর থেকে একটু দূরে, গ্রামের পাশের ছোট্ট পাহাড়ের পাদদেশে যাবে। যাত্রার শুরুতেই রীনা অনুভব করে প্রকৃতির সৌন্দর্য। পাখির কূজন, গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু মর্মর ধ্বনি—সব মিলিয়ে যেন এক সুরেলা গান। গাঢ় সবুজ গাছপালার মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয়, সে যেন প্রকৃতির কাছে নিজের হারানো অংশগুলো খুঁজে পাচ্ছে।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে রীনা চুপচাপ বসে। তার চোখে পড়ল দূরের নদীর ক্ষীণ ধারা, সূর্যের সোনালী আলোতে ঝিলমিল করছে। গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে সে প্রকৃতির নির্মল গন্ধ অনুভব করে। চারপাশে কোনো কোলাহল নেই, শুধু প্রকৃতির নিখাদ স্নিগ্ধতা। একসময় রীনার ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। তার মনের জটিল ভাবগুলো যেন বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে। প্রকৃতির এই মধুর ছোঁয়া তার মনে নতুন আশার আলো জ্বালায়। ফিরে আসার পথে রীনা অনুভব করে, তার ভেতর এক অন্য রকম শান্তি। শহরের ব্যস্ত জীবনে ফিরে গেলেও, এই প্রাকৃতিক থেরাপি তার মনে অনেক দিন ধরে শক্তি ও ইতিবাচকতা জোগাবে। ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিক জীবনে রীনার দিনগুলো যেন এক ঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন একই রুটিন, ক্লান্তিকর কাজ আর মানুষের ভিড়ে মনের কোথাও যেন এক ধরনের শূন্যতা জমে উঠছিল। একদিন সকালে, জানালার ধারে বসে সূর্যের আলো গায়ে মেখে রীনা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, সে শহর থেকে দূরে প্রকৃতির কাছে সময় কাটাবে। পরের দিন ভোরবেলায় রীনা তার ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে বাসে চেপে সে রওনা দেয় গ্রামের পথে। চারপাশে দূরের সবুজ মাঠ আর পাহাড়ের ঝলমলে দৃশ্য দেখতে দেখতে তার মনে এক ধরনের প্রশান্তি আসতে শুরু করে। গন্তব্যে পৌঁছে রীনা হাঁটতে শুরু করে। পথের দু’পাশে কাশফুলের দোল, দূরে ছোট্ট পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের গাঢ় চাদর। রীনার মনে হয়, সে যেন কোনো গল্পের বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবতায় পা রেখেছে। একটি ছোট্ট ঝরনার ধারে এসে সে থামে। ঝরনার পানির শব্দ, ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া আর চারপাশের নিস্তব্ধ প্রকৃতি তাকে মুহূর্তেই মোহিত করে ফেলে।
সে জুতো খুলে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে। ঠান্ডা পানির স্পর্শ যেন তার সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। কিছুক্ষণ পরে, সে পাহাড়ের পথ ধরে উপরে উঠতে শুরু করে। রাস্তাটা বেশ পাথুরে, তবে প্রতিটি ধাপেই যেন প্রকৃতির নতুন নতুন রূপ ধরা দেয়। পাখির ডাক, পাতা ঝরার শব্দ, আর মাঝে মাঝে জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসা অজানা জীবের ডাক তাকে অবাক করে। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে রীনা থেমে যায়। চারদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজে ঘেরা, আর সেই সবুজের মাঝে একটি নদী তার বুকে সূর্যের আলো ধরে স্ফটিকের মতো ঝিকমিক করছে। সে গভীর নিঃশ্বাস নেয়। এই জায়গাটা যেন এক স্বর্গ। রীনা অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে থাকে। কোনো চিন্তা নেই, শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা।
সে ভাবে, কেন আমরা এত ব্যস্ত জীবনে নিজেদের গৃহবন্দী করি? প্রকৃতির এই স্নিগ্ধতা, এই শান্তি—এসব তো আমাদের জীবনেরই অংশ। সন্ধ্যা নামার আগে সে নিচে নেমে আসে। এবার তার পথ ছোট্ট গ্রামের পাশ দিয়ে। গ্রামের মানুষজনের সরল হাসি, তাদের কাঁচা ঘরের চৌকাঠে বসে গল্প করার দৃশ্য, এবং চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সজীবতা দেখে রীনার মনে হয়, এটাই জীবনের আসল রূপ। শহরে ফিরে যাওয়ার সময় রীনার মনে এক ধরনের পরিপূর্ণতা। সে অনুভব করে, প্রকৃতি শুধু আমাদের চোখের সৌন্দর্য নয়, এটা আমাদের মনেরও থেরাপি। এই যাত্রা তার ভেতরে একটি শক্তি আর শান্তি এনে দিয়েছে, যা সে তার জীবনের প্রতিদিনের যুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে। শহরে ফেরার পর রীনার জীবন যেন একটু বদলে যায়। সেই যান্ত্রিক রুটিনের মাঝেও এবার সে প্রকৃতির সংস্পর্শে পাওয়া প্রশান্তি মনে ধরে রাখে। অফিসের ব্যস্ততা আর কাজের চাপ আগের মতোই আছে, তবে এবার সে আর ভেঙে পড়ে না। কারণ তার ভেতরে প্রকৃতি থেকে পাওয়া এক নতুন শক্তি কাজ করে। রীনা রাতে ঘুমানোর আগে পাহাড়ে কাটানো সেই দিনের কথা ভাবতে থাকে। ঝরনার শব্দ, বাতাসের স্নিগ্ধতা আর পাখির ডাক যেন তার মনের গহীনে বাজে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এই অনুভূতিকে শুধু নিজের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখবে না, বরং তার আশপাশের মানুষদের সঙ্গেও ভাগ করে নেবে। পরের দিন রীনা তার কয়েকজন সহকর্মীকে ডাকে।
চায়ের টেবিলে বসে সে তার গ্রামের অভিজ্ঞতার কথা বলে। সবাই তার গল্প শুনে মুগ্ধ হয়। এক সহকর্মী, সুমন, বলে, "তুমি যা বললে, তা শুনে মনে হচ্ছে প্রকৃতির কাছাকাছি না গেলে আমরা আসলেই জীবন থেকে অনেক কিছু মিস করছি। আমরা কি সবাই মিলে একদিন এমন একটা যাত্রা করতে পারি?" এই প্রস্তাবে সবাই একমত হয়। রীনা এবার তাদের নিয়ে আরেকটি পরিকল্পনা করে। এক সপ্তাহ পর তারা একটি ছোট গ্রুপ তৈরি করে এবং সপ্তাহান্তে কাছাকাছি কোনো গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শনিবার সকালে রীনা ও তার বন্ধুরা যাত্রা শুরু করে। এবার তাদের গন্তব্য শহর থেকে একটু দূরে, একটি জলাভূমির ধারে ছোট্ট একটি গ্রাম। পুরো পথেই রীনা তাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতার গুরুত্ব বোঝাতে থাকে। সে বলে, "আমরা যারা শহরে থাকি, তাদের জন্য প্রকৃতি হলো এক ধরনের নিরাময় কেন্দ্র। এখানে এলে মনে হয়, আমরা নতুন করে বাঁচতে শিখি।" গ্রামে পৌঁছানোর পর তাদের সবাই অবাক হয়ে যায়। ধানক্ষেতের মাঝখানে বয়ে চলা ছোট্ট নদী, তার ধারে বড় বড় গাছের ছায়া আর মাটির ঘরের দৃশ্য তাদের মন ছুঁয়ে যায়। সবাই মিলে নদীর ধারে হাঁটতে থাকে। তারা পাখির ডাক আর হাওয়ার শব্দ শুনে মুগ্ধ হয়।সুমন বলে, "রীনা, তুমি ঠিকই বলেছিলে। এখানে এসে মনে হচ্ছে, আমরা যেন আসল পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। এতদিন শহরের কৃত্রিম জগতে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম প্রকৃতিকে।" তারা সেদিন সারাদিন গ্রামে কাটায়। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের জীবনযাপন দেখে, এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটায়। সন্ধ্যায় তারা সবাই মিলে একটি মাটির চুলায় রান্না করা খিচুড়ি খায়। এমন সহজ, সাদামাটা খাবার খেয়ে তাদের মনে হয়, এর চেয়ে সুস্বাদু কিছু তারা আর খায়নি। ফিরে আসার পর রীনা ও তার বন্ধুরা তাদের জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনে। রীনা প্রতিদিন সকালে সামান্য হলেও প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোর চেষ্টা করে। তার বন্ধুরা কেউ ছাদে গাছ লাগায়, কেউ ছুটির দিনে গ্রামের দিকে বেড়াতে যায়। একদিন সুমন রীনাকে বলে, "তুমি জানো, তোমার ওই ছোট্ট গল্প থেকে আমাদের জীবনে কত বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। এখন আমি বুঝি, প্রকৃতির সঙ্গে থাকা শুধু বিনোদন নয়, এটি আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য।" রীনা হাসে। সে জানে, তার সেই ছোট্ট যাত্রা শুধু তার নিজের নয়, বরং আরও অনেকের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। তার মনে হয়, প্রকৃতি আমাদের জীবনে আসলেই এক আশীর্বাদ, যা শুধু প্রশান্তি নয়, বরং জীবনের নতুন দিশাও দেখায়। সময় বয়ে যায়, কিন্তু রীনা ও তার বন্ধুরা তাদের প্রকৃতিপ্রেমী অভ্যাস ধরে রাখে। প্রতি মাসেই তারা নতুন কোনো জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এবার রীনার মনে হলো, শুধু নিজেরা প্রকৃতির কাছে গিয়ে শান্তি খোঁজা যথেষ্ট নয়।
প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ও উপকারিতা যাতে টিকে থাকে, তার জন্যও কিছু করা উচিত। একদিন রীনা তাদের গ্রুপ মিটিং-এ প্রস্তাব দেয়, "প্রকৃতিকে শুধু উপভোগ করা নয়, আমাদের তার সুরক্ষার দায়িত্বও নিতে হবে। কেননা, এই সবুজ পৃথিবী যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আমরা এই শান্তি আর কোথাও খুঁজে পাব না।" সুমন সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়, "তুমি একদম ঠিক বলেছো, রীনা। কিন্তু আমরা কীভাবে শুরু করব?" রীনা একটু চিন্তা করে বলে, "আমরা প্রথমে নিজেদের কমিউনিটিতে কাজ শুরু করতে পারি। যেমন, গাছ লাগানো, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা তৈরি করা। আর প্রতি ভ্রমণে আমরা গিয়ে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকেও এই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারি।" সবাই রীনার প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়। পরের সপ্তাহে তারা শহরের পার্শ্ববর্তী একটি পার্কে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করে। রীনা অফিস থেকে অনুমতি নেয় এবং কিছু চারা কিনে আনে। তারা নিজেরাই গাছ লাগানো শুরু করে। সেই সঙ্গে পার্কে আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে গাছের গুরুত্ব বোঝায়। তাদের কাজ দেখে পার্কের স্থানীয় কিছু বাসিন্দা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এক বৃদ্ধ বলেন, "আমরা যারা এই শহরে অনেক বছর ধরে আছি, তারা জানি, আগে এখানে কেমন সুন্দর পরিবেশ ছিল। কিন্তু এখন দূষণে সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। তোমাদের দেখে খুব ভালো লাগছে।" রীনা হাসিমুখে উত্তর দেয়, "আমরা একসঙ্গে চেষ্টা করলে পরিবেশটা আবার আগের মতো করতে পারব।"এরপর তাদের দলটি একটি গ্রামের স্কুলে যায়, যেখানে প্রকৃতি সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করার একটি কর্মশালার আয়োজন করে। তারা শিশুদের বিভিন্ন গাছের চারা দেয় এবং শেখায় কীভাবে গাছ লাগাতে হয়। রীনা ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গে কথা বলে। একটি মেয়ে, মুনিয়া, তাকে জিজ্ঞাসা করে, "আপু, আমি যদি গাছ লাগাই, তাহলে কি আমার পুরো গ্রাম সুন্দর হয়ে যাবে?" রীনা মুনিয়ার মাথায় হাত রেখে বলে, "হ্যাঁ, মুনিয়া। একদিন তোমার গ্রাম শুধু সুন্দরই হবে না, বরং তোমার লাগানো গাছগুলো তোমাদের সবার জন্য ছায়া, ফল আর শান্তি এনে দেবে।" শিশুদের এই উচ্ছ্বাস দেখে রীনা ও তার দল আরও অনুপ্রাণিত হয়।ধীরে ধীরে তাদের কাজের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তারা শহরের অন্যান্য কমিউনিটিকেও এই উদ্যোগে যুক্ত করে। তাদের দেখাদেখি আরও অনেকেই গাছ লাগানো, পরিবেশ দূষণ রোধ, এবং সচেতনতা বাড়ানোর কাজে যোগ দেয়। এভাবে সময়ের সঙ্গে রীনা উপলব্ধি করে, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে শুধু নিজের ভেতরেই শান্তি পাওয়া যায় না, বরং একে সংরক্ষণ করে অন্যদের জন্যও সেই শান্তি নিশ্চিত করা যায়। একদিন সন্ধ্যায়, রীনা আবার তার সেই প্রথম যাত্রার কথা মনে করে। মনে পড়ে সেই ঝরনার শব্দ, পাখির ডাক আর পাহাড়ের সবুজ চূড়া।
তার মনে হয়, যদি সে সেদিন এই সিদ্ধান্ত না নিত, তাহলে হয়তো এই নতুন জীবনের পথ তার কখনোই খুঁজে পাওয়া হতো না। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক শুধু তা দেখার বা উপভোগ করার নয়, বরং তা রক্ষারও। রীনা এখন এক নতুন জীবনের পথে হাঁটছে, যেখানে সে শুধু নিজের শান্তি নয়, বরং চারপাশের পরিবেশ আর মানুষের ভালো থাকার দিকেও লক্ষ্য রাখে। তার কাছে, প্রকৃতি শুধু একদিনের অভিজ্ঞতা নয়, বরং জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। রীনার জীবনে প্রকৃতিকে রক্ষার উদ্যোগ যেন তার পরিচয়েরই এক নতুন দিক হয়ে উঠল। একদিন তার বন্ধু সুমন প্রস্তাব দেয়, "রীনা, আমরা শহরের বাইরে কাজ করছি ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের শহরের মধ্যেও তো পরিবেশ রক্ষায় অনেক কিছু করা দরকার।" রীনা একমত হয়। তারা ঠিক করে, শহরের স্কুলগুলোতে গিয়ে শিশুদের প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করবে। তারা "প্রকৃতি ক্লাব" নামে একটি উদ্যোগ শুরু করে, যেখানে শিশুদের পরিবেশ রক্ষা, গাছ লাগানো, এবং প্লাস্টিক বর্জনের মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রথম প্রকৃতি ক্লাব গড়ে ওঠে শহরের এক স্কুলে। রীনা ও তার দল ক্লাবের সদস্য শিশুদের গাছ লাগানোর প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত করে। শিশুরা দারুণ উৎসাহ নিয়ে অংশ নেয়। তাদের কেউ কেউ নিজ বাড়ির ছাদে গাছ লাগায়, কেউ স্কুলের মাঠে একদিন এক ছাত্র, জয়, রীনাকে বলে, "আপু, আমি আমার মাকে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছি। আমরা এখন কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করি।" রীনার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে ভাবে, এই ছোট ছোট উদ্যোগই একদিন বড় পরিবর্তনের কারণ হবে। তাদের ক্লাবের প্রভাব শহরের আরও স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মিডিয়া তাদের কাজ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ধীরে ধীরে মানুষ প্রকৃতি রক্ষার কাজে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করে। এরপর রীনার দল সিদ্ধান্ত নেয়, পরিবেশ সচেতনতার জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করবে। এই অ্যাপের মাধ্যমে মানুষ সহজেই জানতে পারবে কোথায় গাছ লাগানো দরকার, কীভাবে বর্জ্য পুনঃব্যবহার করা যায়, এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য কোথায় পাওয়া যায়। সুমন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। সে দল নিয়ে অ্যাপটি তৈরি করতে শুরু করে।
"গ্রিনলাইফ" নামের এই অ্যাপটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ এটি ব্যবহার করে গাছ লাগানোর স্থান চিহ্নিত করে, নিজেদের উদ্যোগ শেয়ার করে, এবং অন্যান্য পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পে যোগ দেয়। তবে তাদের পথটা সবসময় মসৃণ ছিল না। কিছু জায়গায় মানুষের মধ্যে আগ্রহ কম ছিল। কেউ কেউ তাদের প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে চাইত না। একদিন, রীনা একটি সভায় দাঁড়িয়ে বলে, "আমি জানি, এই কাজটা কঠিন। কিন্তু আমরা যদি এখনই না শুরু করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কিছুই রেখে যেতে পারব না। আমাদের এই পৃথিবী শুধু আমাদের নয়, বরং তাদেরও, যারা এখনো জন্ম নেয়নি।" রীনার কথাগুলো মানুষের মনে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ধীরে ধীরে আরও মানুষ তাদের কাজে যুক্ত হতে শুরু করে। তাদের কাজ একদিন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা রীনা এবং তার দলের কাজের প্রশংসা করে। তারা রীনাকে আমন্ত্রণ জানায় এক সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে। সম্মেলনে রীনা তার গল্প শোনায়—কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একটি পাহাড়ি গ্রামে কাটানো একটি দিন তার পুরো জীবন বদলে দিয়েছিল।
সে বলে, "আমরা যদি প্রকৃতির কাছাকাছি আসি, তাহলে শুধু নিজেদের শান্তি পাই না, বরং জীবনের আসল মানে বুঝি। প্রকৃতি আমাদের শেখায় কিভাবে একসঙ্গে থাকতে হয় এবং একে অপরকে সাহায্য করতে হয়।" তার বক্তৃতা সবার মন জয় করে। অনেক দেশ তাদের মডেল অনুসরণ করে নিজেদের পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রীনার কাজ আরও বিস্তৃত হয়। সে শুধু শহর বা গ্রামেই নয়, বরং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে মানুষকে প্রকৃতির সংস্পর্শে এনে সচেতন করার কাজ শুরু করে। একদিন সন্ধ্যায় রীনা তার ছাদে বসে। চারপাশে তার লাগানো গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছে। পাখিরা সেখানে এসে বাসা বেঁধেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, "আমার ছোট্ট একটি যাত্রা এতদূর আসবে, কখনো ভাবিনি।" তার চোখে এক ধরনের তৃপ্তির ঝিলিক। কারণ সে জানে, তার কাজ শুধুই একটি আন্দোলন নয়, বরং একটি নতুন জীবনধারার সূচনা।
Comments
Post a Comment